আফরোজা সোমার ধারাবাহিক গদ্য

প্রকাশঃ মার্চ ৭, ২০১৬ সময়ঃ ১২:২৬ অপরাহ্ণ.. সর্বশেষ সম্পাদনাঃ ৭:৪৪ অপরাহ্ণ

আফরোজা সোমা

soma-3

সেখানে তারারা শোনায় গল্প; হাওয়ারা গাছের ছেঁড়া কলাপাতায় বাজায় বাদ্য; ঢেউয়েরা অবিরল শোনায় সঙ্গীত। সেখানে পৃথিবীর দূরতম এক কোণে তার সাথে দেখা। সকালের সেই রোদের মতই উছলে পড়া ছিল তার চোখ। তার থুঁতনির লম্বা গড়নে ছিল তলোয়ারের বাঁকা রেখার মতন সুতীব্র মায়া।

কুতুবদিয়ার সাগরপাড়ে, জল যেখানে আছড়ে পড়ে মুর্হূমুর্হূ তার থেকে মাত্র ৪০ বা ৫০ মিটার দূরে, পলিথিনে মোড়ানো ছোটো এক ঘরের সামনে ভীড়ের মধ্যে সে ছিল দাঁড়িয়ে। দারিদ্র্যপীড়িত বাঁধের  শীর্ণ গোটা পঞ্চাশেক শিশু ও কিশোরের মধ্যে তার চোখ ছিল উজ্জ্বলতর, ছিল চোরাবালীর মতন গোপন শিকারী।

বিদেশী এক অধ্যাপকের সাথে গিয়েছিলাম ডকুমেন্টারি তৈরির কাজে। নভেম্বরের ঊষায় হালকার চেয়ে খানিকটা বেশি কুয়াশার মধ্যে কুতুবদিয়ায় সাগরের বুকে লালনীল বাতিগুলো জ্বেলে নোঙর করা জাহাজগুলো ছিল স্বপ্নের মতন দূরত্ব ও নৈকট্যের সীমানা অনির্ধারিত বিন্দুতে। কুয়াশার আড়াল ভেঙে জেলে নৌকো হতে মাছ নামানোর হুল্লোড়ভরা মুহূর্তগুলো ছিল ব্যাঞ্জনাময়, ছিল চুম্বকীয়।

নভেম্বরের সেই ঊষা সকালে গড়িয়েছে। জেলে নৌকোর কাজ সেরে সেই অধ্যাপকের সঙ্গে আমরা ঢুকেছি লোকালয়ে। ৯১ এর ঝড়ে কুদুবদিয়ায় যারা স্বজন হারিয়েছেন, যারা বেঁচে আছেন, যারা সব হারিয়ে আবার ঘুরে দাঁড়িয়েছেন, স্রোতের টানে দূরে কোথায় ভেসে গিয়ে অন্য আরেক জেলায় আটকে যে জেলে বহুদিন পরে আবার ফিরেছেন নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়া নিজের জন্মভিটার স্মৃতির কাছে এমন মানুষদের আমরা খুঁজে বেরিয়েছি।  কথা বলেছি।  সাগরের চরিত্র কী করে পাল্টে যাচ্ছে, জলবায়ু পরিবর্তন কী করে স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হয়ে উঠছে দ্বীপবাসীদের জীবনে সেই গল্প প্রত্যক্ষর্দশীদের থেকে নিবিড়ে আমরা আলাপে জানতে চেয়েছি।

কিন্তু নভেম্বরের এই সফরে সেইসব আলাপ আমার মূখ্য স্মৃতি নয়। আমার স্মৃতি এক উছলে পড়া হাসি। শিকারীর মতন আমার পিছু নেয়া মায়াময় একজোড়া চোখ। সেই শিকারীর নাম রিনা।  তলোয়ারের ডগার মতন তীক্ষ্ম, লম্বাটে আর বাঁকা ওর থুঁতনি। বাঁকা সেই থুঁতনিতেই যেনো মা-প্রকৃতি রেখেছেন জগতের সকল মায়া।

রিনা’র বয়স ১০ কি ১১।  ওর সঙ্গে প্রথম চোখাচোখি হওয়ার সময়ই আমার কেমন যেনো লাগলো। কেমন একটা চোরাটান! এরপর  চার পাঁচ ঘন্টা সময় আমরা সাগরপাড়ে ছিলাম। সঙ্গে সঙ্গে ছায়ার মতন ছিল রিনা। হয়তো সে বুঝেছিল আমার হৃদয়ের ভাষা।

কিশোর-কিশোরীর দলের মধ্যে সে ছিল তুলনামূলক লাজুক; লাজুক তার হাসি। কোঁকড়ানো চুল ঘাড় ছাড়িয়ে নেমে গেছে পিঠের দিকে। শ্যামলা তার বরণ। ছেলে-মেয়ের দল যখন নিয়েছে আমাদের ক্যামেরার পিছু, যখন তাদের সামলে কাঙ্ক্ষিত দৃশ্য ধারণ করতে আমাদের অস্থির দশা, তখন রিনা আমাদের হয়ে কাউকে-কাউকে সামলেছে। 

সব কাজ সাঙ্গ হলে সাগরপাড় থেকে যখন আমরা অন্য লোকালয়ের দিকে যাবো, বাঁধের দিকে যাবো, তখন রিনা লাজুক হেসে অতর্কিতে আমার হাতে গুঁজে দেয় সাগর থেকে কুড়িয়ে পাওয়া একটা বড় শামুক। মুহূর্তে আমার কেমন যেনো লাগে। কেমন অপার্থিব এক মুহূর্ত যেনো।  

৯১-এর ঘূর্ণিঝড়ের পরে লোকালয়কে রক্ষা করার জন্য নতুন যে বাঁধ দেওয়া হয়েছিল রিনার পরিবার সেখানেই থাকে। তাই, রিনা এবারেও আমাদের পিছু-পিছু যায়।  আমরা যখন বাঁধে যাই, এক্সট্রিম ক্লোজআপে নিই চামড়ায় অগুন্তি ভাঁজ পড়ে যাওয়া কোমড়-বাঁকা এক বুড়ির মুখ;  বাঁধের উপর ময়লার ধারে খেলতে থাকা একটা শিশুর হাসি; একপাল মুরগি ও হাসের দল বেঁধে দৌঁড়োনোর দৃশ্যের দিকে যখন ধীরে-ধীরে জুম-ইন করি তখন এক ফাঁকে রিনা আমার হাত ধরে টানে। বলে: ঐ যে ঐখানে আমাদের ঘর। যাবেন?

আমি বলি: চলো। সঙ্গের অধ্যাপককেও বলি: চলো। ওখানে তুমি ওর মায়ের সঙ্গে কথা বলবে। ওই অধ্যাপককে গল্প খুঁজে দেয়ার উছিলায় আমি রিনার মায়ের সাথে গল্প করি। রিনার মা, তাদের পোষা কয়েকটা ছাগল নিয়ে গল্প করেন। এই ছাগলগুলো বড় হলে বেচে কিছু পয়সা পাওয়া যাবে সেই গল্প করেন। 

গল্পের সময় রিনা আমার পাশে দাঁড়িয়ে থাকে, গা-ঘেঁষে। আমাদের সময় শেষ। আরো কাজ পড়ে আছে। তাড়াহুড়ো। তাই এখান থেকে যেতে হবে। রিনাকে বলি: যাই; ভালো থেকো।

কিন্তু ভালো থেকো বলতে–বলতে আমার কেমন যেনো লাগে। আমি ভালো থাকার সংজ্ঞা জানি না। এই বাঁধের উপর, এই ভাঙা ঘরে ভালো থাকা যায় কি-না জানি না। আর ভালো না থাকলে থুঁৎনিতে এতো মায়া কী করে থাকে! জানি না।

আমার সঙ্গে সবসময় চকলেট থাকে। দূরে কোথাও গেলে একটু বেশি রকমের নানান পদের লজেন্স, চকলেট। কিন্তু এতক্ষণে ব্যাগে থাকা লজেন্স, চকলেট প্রায় শেষ। তেমন কিছু নেই। বিদায়ের সময় রিনাকে কী দিই! ব্যাগ হাতড়ে একটা লজেন্স, একটা চকলেট—জানিনা সাফারি না অন্য কিছু—ওর হাতে গুঁজে দিয়ে আবারো বলি: যাই। ভালো থেকো।

একবার খুব মনে হয়েছিল, রিনাকে বলি: তোমার ঠিকানাটা লিখে দাও। চিঠি লিখব।

কিন্তু এসব কি বলা যায় যে, চিঠি লিখে আমি তোমার উছলে পড়া হাসির খবর নেবো; তোমার তীক্ষ্ম থুঁতনির খবর নেবো; চিঠি লিখে আমি খবর নেবো তোমাদের ছাগশিশুগুলো কতবড় হলো!  ঠিকানাটা আমার নেয়া হয় না।

কিন্তু আজো এতো বছর পরেও রিনার কথা মনে পড়ে। রিনার দেয়া সেই শামুকের দিকে আজও প্রায় রোজই আমার চোখ যায়। আর মনে হয়, আরেকবার যাই পৃথিবীর সেই দূরতম কোণে— যেখানে ছেঁড়া কলাপাতায় সাগরের হাওয়া এসে বাজায় বাদ্য, যেখানে ঘরের ফোঁকর দিয়ে আকাশের তারারা দেয় আরো কোন দূরতম পৃথিবীর মোহনীয় ইশারা। কিন্তু এই এতো বছর পর রিনা কি চিনবে দূর থেকে যাওয়া এই আগুন্তুকের মুখ? না-কি আমিই চিনবো ওকে? ওর চোখের বাদামী মণি, থুঁৎনির বাঁক?

—–

আরো সংবাদঃ

মন্তব্য করুনঃ

পাঠকের মন্তব্য

20G